হাফেজ মুহাম্মদ আবুল মঞ্জুর

ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সামাজিক গাম্ভীর্য সবদিক থেকেই একটি সমৃদ্ধ জনপদ কক্সবাজার জেলা। যুগে যুগে বহু গুণীজন জন্মছেন সমূদ্র নগরী কক্সবাজারে। মাওলানা আবুল কালাম মুরাদ রহ. সেই আলোকিত মানুষদের একজন। তিনি ছিলেন, একাধারে একজন বিজ্ঞ  আলেমেদ্বীন, প্রাজ্ঞ খতীব, সুবক্তা, তাত্ত্বিক লেখক, আদর্শ শিক্ষক, একনিষ্ঠ সমাজহিতৈষী ।

কক্সবাজারের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র বাংলাবাজার ছুরতিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার দীর্ঘসময়ের অধ্যক্ষ হিসেবে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। সে মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কারণে বিদগ্ধ এ আলেমেদ্বীনের ছাত্রত্ব লাভের সুবাদে তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁকে দেখেছি একজন আদর্শ শিক্ষক, চৌকস অধ্যক্ষ, প্রাজ্ঞ আলেমেদ্বীন ও বিজ্ঞ আলোচক হিসেবে। অত্যন্ত মার্জিত ভাষায় কথা বলতেন। জ্ঞান-প্রজ্ঞার দীপ্তি ছড়িয়ে তৃপ্ত করতেন শিক্ষার্থীদের। বিজ্ঞতাপূর্ণ পাঠদানে মুগ্ধতা ছড়িয়ে পুরো ক্লাসকে করে তুলতেন প্রাণবন্ত।

সামাজিক শিষ্টাচারিতার দিক থেকেও তিনি ছিলেন মার্জিতভাষী, অতিথিপরায়ণ, বন্ধুবৎসল ও জনবান্ধব একজন সমাজসচেতন আলেমেদ্বীন। তিনি ছিলেন, সদা প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল, কর্মোদ্যমী, ভদ্র, বিনয়ী। একসাথে ইতিবাচকধারার এমন গুণাবলিতে বিভূষিত মানুষের সংখ্যা সমাজে দিনদিন কমে যাচ্ছে।

জন্ম:
অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কালাম মুরাদ রহ. ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা মাস্টার পাড়ার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতা মরহুম গোলাম আলী সওদাগরের বড় ছেলে।

শিক্ষাজীবন:
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন জ্ঞান অনুসন্ধিৎসু ও প্রখর মেধাবী। ঐতিহ্যবাহী মক্তবে কুরআন মজীদের শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই তাঁর ছাত্রজীবনের সূচনা। তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর সমাপ্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ছাত্রজীবনের প্রায় সকল পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকারের গৌরব অর্জন করেন। ফলে সে সময়কালের সেরা মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি খ্যাতি পেয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবনে ক্রমান্বয়ে তিনি বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পটিয়া হাশিমপুর মকবুলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৯৮৫ ঈসায়ীতে আলিম, ১৯৮৭ ঈসায়ীতে ফাযিল, ১৯৮৯ ঈসায়ীতে কক্সবাজার হাশেমিয়া কামিল মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ করেন। তিনি ১৯৯১ ঈসায়ীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে বি.এ অনার্স এবং ১৯৯৬ ঈসায়ীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এম. এ পাশ করেন।
উল্লেখ্য, তিনি আলিয়া মাদ্রাসার পাশাপাশি কওমী শিক্ষাধারায়ও পড়াশোনা করেছেন বলে জানতাম। তবে সে সম্পর্কিত প্রামাণ্য কাগজাদি পরিবারের সংরক্ষণে না থাকায় বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়নি।
প্রাতিষ্ঠানিক ছাত্রজীবন সমাপ্তির পর তিনি গবেষণাধর্মী পড়ালেখায়ও মনোনিবেশ করেন। তিনি ছিলেন একজন রিসার্চ স্কলার ও কলামিস্ট। আরবী, বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি বিষয়েও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন।

কর্মজীবন:
বিদগ্ধ এ আলেমেদ্বীন কর্মজীবনে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের মহান ব্রত নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাধারায় শিক্ষকতার খেদমতে যুক্ত হন। জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনে সহকারী জজ হিসেব নির্বাচিত হওয়ার পরও তিনি যোগদান না করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারকে প্রাধান্য দেন। মরহুম পিতাও তাঁকে দুনিয়ার মোহে না জড়িয়ে ইসলামী জীবনধারায় নিবেদিত থাকার ওসীয়ত করে গিয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৪ সালে সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন চট্টগ্রামের বোয়ালখালি জ্যৈষ্ঠপুরা ইসলামিয়া হামেদিয়া সিনিয়ার মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে তিনি পেকুয়া মেহেরনামা আলমাছিয়া মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ১ আগষ্ট’২০০০ ঈসায়ী তারিখে কক্সবাজার জেলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুরতিয়া সিনিয়র মাদ্রাসায় অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকে শিক্ষার মানোন্নয়নের সাথে সাথে মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়নেও যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দেন। ৯ জুলাই’২০২০ ঈসায়ী তারিখ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ (আমৃত্যু) তিনি এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হিসেবে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে অনন্য অবদান রেখে গিয়েছেন।
সবমিলিয়ে সুদীর্ঘ ২৫ বছরের অধিক সময় তিনি সুনামের সাথে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ২০০৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উদযাপন কমিটি কর্তৃক তিনি (মাদ্রাসা পর্যায়ে) শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান নির্বাচিত হন। তাঁর হাতে গড়া বহু শিক্ষার্থী ইসলাম, দেশ ও জাতির কল্যাণে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

তিনি উল্লেখযোগ্য সময় চকরিয়ার প্রাণকেন্দ্র চিরিঙ্গা সোসাইটি শাহী জামে মসজিদের খতিব হিসেবে পালন করেন। মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি চকরিয়া পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের ঘনশ্যম বাজার জামে মসজিদের খতিবের দায়িত্বরত ছিলেন।

বহুমুখী অবদান:
বহুমাত্রিক প্রতিভাধর এ আলেমেদ্বীন দায়িত্বশীলতার সাথে মাদ্রাসা অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন ও শিক্ষকতার পাশাপাশি জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজারে ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রজ্ঞাদীপ্ত আলোচনা করতেন তিনি। সেই সাথে সংবাদপত্রে লেখালেখি এবং ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে দ্বীনি দাওয়াতের অঙ্গনেও তিনি সরব ছিলেন আজীবন।

ইসলামের প্রকৃত বার্তা ও  চিরন্তন সৌন্দর্য জনসাধারণের মাঝে পৌঁছে দিতে তাঁর কর্মপ্রয়াস প্রশংসনীয়। দ্বীনি সভা-মজলিসে বক্তা হিসেবে তিনি নির্মোহভাবে অংশ নিতেন। হাদিয়া-তোহফার বিষয়ে তাঁর কোন চাহিদা ছিলো না। তিনি সবসময় মাঠে- ময়দানে শিরক-বিদ্আত ও তাগুতের বিরুদ্ধে মানুষদের সচেতন করতেন। তিনি জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা পেশ করার সময় উপমহাদেশের অন্যতম দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের কবিতার পঙক্তি বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনায় আবৃত্তি করতেন।

লেখালেখি:
তিনি লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চায়ও ছিলেন ভালোই  যত্নশীল। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে মাদ্রাসা পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত  মিযান ও মুনশায়েবের অাধুনিক বাংলা বিশ্লেষণ অন্যতম। সংবাদপত্রেও তিনি সময়োপযোগী প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখতেন। এছাড়াও “স্মৃতির পাতায় মক্কা-মদীনা” সহ বিভিন্ন বিষয়ে অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি রয়েছে বলে জানিয়েছেন, তাঁর সুযোগ্য ছেলে, চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়নরত কাউসার মাহমুদ গালিব।

ইন্তেকাল:
জেলার বরেণ্য এ আলেমেদ্বীন ২০২০ সালের ১০ জুলাই, জুমাবার ভোরে ৫৬ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন- ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি স্ত্রী, ৩ ছেলে, ১ মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে যান।একইদিন (জুমাবার) আসরের নামাযের পর নামার চিরিঙ্গা পুরাতন কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মাঠে বিপুল সংখ্যক শোকার্ত তৌহিদী জনতার অংশগ্রহণে নামাযে জানাযা শেষে মরহুমকে দাফন করা হয়।
উল্লেখ্য, অধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কালাম মুরাদ রহ. হার্ট অ্যাটাক করলে ২০২০ সালের ১ জুলাই উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্রগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে সিসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয়ে উঠলে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। পরে হঠাৎ আবারো অসুস্থ পড়ল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ১০ জুলাই’২০২০ ঈসায়ী তারিখে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ক্ষণকালের এ পৃথিবীকে চিরবিদায় জানিয়ে অনন্ত জগতে পাড়ি জমান। হুজুরের ইন্তেকালে আমরা একজন আলোকিত মানুষকে হারিয়েছি।

দেখতে দেখতে আজ হুজুরের ইন্তেকালের চার বছর হয়ে গেলো! তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর কীর্তিময় জীবন স্মরণীয় হয়ে আছে, থাকবে চির অম্লান হয়ে স্মৃতির পাতায়, ইতিহাসের খাতায়। আল্লাহ আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, মরহুম এ আলেমেদ্বীনকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন। আমিন।

লেখক:
খতিব-
শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট জামে মসজিদ, কক্সবাজার।
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-
কক্সবাজার ইসলামী সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদ।